সানস্ক্রিন ক্রিম ব্যবহারের নিয়ম

সানস্ক্রিন ক্রিম ব্যবহারের সঠিক নিয়ম

দিনের শুরুতে ঘরের বাইরে কে না বের হয় বলুন তো? এদিকে ধুলো-বালি, সূর্যের আলট্রাভায়োলেট রে বা অতিবেগুনী রশ্মি, ঘাম সব মিলে ত্বকের অবস্থা একেবারে যা তা! 

গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এর এই যুগে সানবার্ন এক আতঙ্কের নাম। তাই টিনেজ থেকেই আমাদের প্রয়োজন হয় প্রতিদিনের ত্বকচর্চা অভ্যেস। আর এই ত্বকচর্চা বা স্কিনকেয়ার-এর কথা উঠলে শুরুতেই আসে সানস্ক্রিনের নাম।

তবে, সানস্ক্রিন কিনে মাখা শুরু করলেই যে সানবার্নের সমস্যা সমাধান হবে তা নয়। সানস্ক্রিন কেনার আগে ত্বকের ধরন, বয়স, স্কিন প্রব্লেম, জেনেটিক ইস্যু নানারকম ব্যাপার মাথায় রেখে কিনতে হয়। তাছাড়া সানস্ক্রিন ক্রিম ব্যবহারের সঠিক নিয়ম জানাও জরুরি। 

এই আর্টিকেলে আমরা জানবো সানস্ক্রিন কী, কীভাবে সানস্ক্রিন ক্রিম ব্যবহার করতে হয়, এর উপকারিতা ও অপকারীতা কি এবং আরো কিছু গুরুত্বপুর্ণ বিষয়।  

সানস্ক্রিন কী?  

ত্বকের যত্নে সচেতন প্রতিটি মানুষই সানস্ক্রিন ক্রিম ব্যবহার করেন। সানস্ক্রিন মূলত এক ধরনের ক্রিম যা বাইরে গেলে সূর্যের ক্ষতিকর আলট্রাভায়োলেট রশ্মি থেকে আমদের ত্বককে সুরক্ষা প্রদান করে। যেহেতু ত্বকের অন্যতম বড় সমস্যাগুলোর একটি সমস্যা হলো সানবার্ন, কাজেই সানস্ক্রিনের বিকল্প স্কিনকেয়ার আসলে নেই। 

সানস্ক্রিন ক্রিমে রয়েছে এসপিএফ অর্থাৎ সান প্রোটেকশন ফ্যাক্টর (Sun Protection Factor) যা কি না সূর্যের ক্ষতিকর আলট্রাভায়োলেট রশ্মি থেকে ত্বককে পুরোপুরি সুরক্ষা দেয়। তার মানে সানস্ক্রিন ক্রিমে যে এসপিএফ থাকে, সেটিই মূলত ত্বককে সানবার্ন ও অন্যান্য সমস্যা থেকে বাঁচায়। 

মার্কেটে যদিও সানস্ক্রিন ও সানব্লক দুটোই পাওয়া যায়, তবে সানব্লক শুধুমাত্র ত্বকের উপরের লেয়ারকে সুরক্ষা প্রদান করে। কিন্তু সানস্ক্রিন ক্রিম ত্বকের কয়েক লেয়ার গভীরে গিয়ে ত্বককে সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মি থেকে বাঁচায়। 

সানস্ক্রিন এর প্রকারভেদ:

সানস্ক্রিন এর প্রকারভেদ

ফরমুলেশনের উপর ভিত্তি করে সানস্ক্রিন সাধারণত দুই ধরনের হয়ে থাকে, ফিজিক্যাল এবং কেমিক্যাল। তবে অনেকেই পার্থক্য ঠিকমত করতে পারেননা বলে বাজারে গিয়ে বিভ্রান্ত হয়ে যান। চলুন জেনে নিই ফিজিক্যাল ও কেমিক্যাল সানস্ক্রিনের আদ্যোপান্ত। 

১। ফিজিক্যাল সানস্ক্রিন: এটিকে অনেকে মেডিকেটেড সানস্ক্রিনও বলেন। এফডিএ অনুমোদিত প্রায় ১৫/১৬ টি উপাদানের সাহায্যে তৈরি এই সানস্ক্রিন মূলত ব্যবহার করা হয় মেছতা দুর করতে। এছাড়া ত্বকের অন্যান্য সমস্যা দুর করতেও এই সানস্ক্রিন ডাক্তাররা পরামর্শ দিয়ে থাকেন। যদিও এই ধরনের সানস্ক্রিনের দাম কিছুটা বেশি কিন্তু এটা একেবারে ননগ্রিজি অর্থাৎ ত্বকে তেলতেলে ভাব অনুভূত হয় না।    

২। কেমিক্যাল সানস্ক্রিন: এই ধরনের সানস্ক্রিনগুলোর মূল উপাদান জিংক অক্সাইড যা কিছুটা হোয়াইট কাস্ট বা সাদাভাব ত্বকে আনে। তবে এগুলো দামে ভীষণ সাশ্রয়ী। এ ধরনের সানস্ক্রিনে কিছুটা গ্রিজিনেস বা তৈলাক্ত ভাব দেখা যায়। যারা দামে সাশ্রয়ী সানস্ক্রিন খুঁজছেন তাদের জন্য কেমিক্যাল সানস্ক্রিন বেস্ট। যেহেতু আপনার উদ্দেশ্য ত্বকে প্রোটেকশন লেয়ার তৈরি করা কাজেই কেমিক্যাল সানস্ক্রিন এ ক্ষেত্রে খুবই উপকারী।  

কোন ত্বকের জন্য কোন সানস্ক্রিন ক্রিম: 

ত্বকের ধরন ও বয়সভেদে সানস্ক্রিন এর রকমফের হয়। আমরা জানি, ত্বকের রয়েছে নানান ধরন। কারো ত্বক তৈলাক্ত আবার কারো শুষ্ক, কারো বা কম্বিনেশন বা সেনসিটিভ। 

তৈলাক্ত ত্বকের জন্য ননগ্রিজি অর্থাৎ জেল বেইজড সানস্ক্রিন বেশি ভালো। এতে করে ত্বকের তৈলাক্ত ভাব একদম থাকে না আর মেকআপ সারাদিন সেট হয়ে থাকে। এ ধরনের ত্বকের জন্য ৫০ এসপিএফ যুক্ত সানস্ক্রিন সবচেয়ে ভালো কাজ করে। 

আবার শুষ্ক ত্বকের জন্য একটু ক্রিম বেইজড সানস্ক্রিন ভালো কারণ এতে করে ত্বকের আর্দ্রতা বজায় থাকে ও ফাটল ধরে না। 

ত্বকের যেসব জায়গা সান এক্সপোজড হয় অর্থাৎ মুখ বাদে হাত, পা, ঘাড় এসব জায়গাতেও নিয়মিত সানস্ক্রিন এপ্লাই করা উচিত। 

সানস্ক্রিন ব্যবহারের নিয়ম: 

যেনতেন ভাবে সানস্ক্রিন লাগালে এটা কখনোই ভালো ফলাফল বয়ে আনবে না। তাই সানস্ক্রিন ব্যবহারের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট নিয়ম অবশ্যই মেনে চলতে হবে। সাধারণত ঘুম থেক উঠেই আমরা ফেসওয়াশ দিয়ে মুখ ধুয়ে ফেলি। রেগুলার স্কিনকেয়ারের সমস্ত ধাপ শেষ করে ময়েশ্চারাইজার লাগিয়ে তারপর সানস্ক্রিন লাগানো উচিত। সানস্ক্রিনকে আপনার স্কিনকেয়ারের শেষ ধাপ হিসেবে রাখুন। কখনোই সানস্ক্রিন লাগানোর পর ফেসিয়াল অয়েল বা এসেনশিয়াল অয়েল ব্যবহার করবেন না। এতে করে ত্বকে গ্রিজিনেস দেখা দেয় এবং তা থেকে ব্রণ তৈরি হতে পারে। 

সানস্ক্রিন কিভাবে এপ্লাই করবেন?

সানস্ক্রিন নরমাল ময়েশ্চারাইজারের মত করে এপ্লাই করলে ত্বকে হোয়াইট কাস্ট দেখা দেয়। সে জন্য প্রথমে পরিমাণ মত ক্রিম আঙুলের ডগায় নিয়ে পুরো ত্বকে ভালো করে মেখে নেবেন। এরপর আঙুলের মাথার সাহায্যে কিছুক্ষণ মাসাজ করার পর ড্যাব ড্যাব করে নিলে আর হোয়াইট কাস্ট দেখা যাবে না। 

সানস্ক্রিন কখন এপ্লাই করবেন? 

ত্বকের যত্নে প্রতিটি স্কিন কেয়ার পণ্যেরই রয়েছে সুনির্দিষ্ট ব্যবহারের নিয়মকানুন। ঠিক তেমনি সানস্ক্রিনেরও রয়েছে নির্দিষ্ট নিয়ম। প্রতিবার বাইরে যাওয়ার সময় অবশ্যই সানস্ক্রিন ব্যবহার করতে হবে। তবে বাসা থেকে বের হওয়ার ঠিক ৩০ মিনিট আগে সানস্ক্রিন মাখবেন। এতে করে এটি আপনার ত্বকে প্রয়োজনীয় লেয়ার তৈরি করবে যা সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মি থেকে আপনার ত্বককে  রক্ষা করবে। 

শুধু যে বাইরে বের হলেই সানস্ক্রিন ব্যবহার করবেন তা নয় বরং ঘরে থাকা অবস্থাতে দিনের শুরুতেই আপনার ত্বকে এপ্লাই করুন সানস্ক্রিন। এরপর দিনে কয়েক ঘণ্টা পরপর রিএপ্লাই করুন। 

সানস্ক্রিন কতক্ষণ পরপর রিএপ্লাই করবেন 

অনেকেই মনে করেন, দিনের শুরুতে বা বাইরে বের হবার আগে একবার সানস্ক্রিন মাখলেই বোধহয় আর সারাদিনে এটা ব্যবহার করতে হবে না। কিন্তু এই ধারণাটি একদম ভুল। সানস্ক্রিন আপনার ত্বককে কখনোই সারদিনের জন্য সুরক্ষা দেবে না। ধরণ অনুযায়ী একেক কোম্পানির সানস্ক্রিন একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সুরক্ষা দেয়। তাই প্রতি দুই থেকে তিন ঘণ্টা পরপর টিস্যু পেপার দিয়ে ত্বক মুছে আবার নতুন করে সানস্ক্রিন এপ্লাই করুন। 

সানস্ক্রিন ব্যবহারের উপকারিতা

সানস্ক্রিন ব্যবহারের উপকারিতা

বিশেষজ্ঞদের মত অনুযায়ী শুধুমাত্র বাইরে নয় বরং ঘরে থাকা অবস্থাতেও সানস্ক্রিন ব্যবহার করা উচিত। ঘরের বাইরে সূর্যের অতিবেগুনী রশ্মি যেমন রয়েছে, তেমনই ঘরের ভিতর রয়েছে আগুনের আঁচ, গরম, নানারকম ডিভাইসের তাপ/রশ্মি ইত্যাদি। এসব কিছুই ত্বকের ক্ষতি করতে পারে বা কালো করে তুলতে পারে। 

চলুন জেনে নিই সানস্ক্রিন মাখলে আপনি কি কি উপকার পাবেন: 

– সানস্ক্রিন ত্বককে সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মি থেকে সুরক্ষা দেয়।  

– ত্বকের কোলাজেন লেয়ার বজায় রাখে ফলে ত্বকে বয়সের ছাপ সহজে পড়ে না।  

– ত্বককে মেছতা ও কালো ছোপ ছোপ দাগ হতে রক্ষা করে।  

– বলিরেখা বা ফাইন লাইনস থেকে বাঁচায়।  

– ত্বকের কোষকে হেলদি রাখে ফলে ত্বক ভিতর থেকে উজ্জ্বলতা হারায় না। 

সানস্ক্রিন ব্যবহারের কিছু অপকারিতা

সানস্ক্রিন যেমন ত্বককে সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মি থেকে বাঁচায়, তেমনি সঠিক নিয়মে ব্যবহার না করলে ভালো ফলাফল নাও পেতে পারেন। যারা নিয়মিত সানস্ক্রিন ব্যবহার করেন, তাদেরকে অবশ্যই একটি নির্দিষ্ট স্কিনকেয়ার রুটিনের দিক মনোযোগ দিতে হবে।

সানস্ক্রিন ব্যবহার করার আগে ত্বক খুব ভালো করে পরিস্কার করে ময়েশ্চারাইজার দিয়ে নেবেন। তেমনই রাতে সানস্ক্রিন তোলার সময় যে কোনো ক্লিনজিং অয়েল দিয়ে ত্বক ভালোভাবে মাসাজ করে তারপর ফোম ক্লিনজার দিয়ে পরিস্কার করবেন। ত্বক পরিস্কারের এই পদ্ধতিকে বলা হয় ডাবল ক্লিনজিং মেথড।   

সারাদিনের ধুলা-বালি ও ময়লা সানস্ক্রিনের সাথে আটকে থেকে ত্বকে ব্রণ তৈরি করে। ডাবল ক্লিনজিং পদ্ধতিতে ত্বক পরিস্কার করলে ত্বকে ময়লা জমে না আবার সানস্ক্রিনের পার্টিকেলও ত্বকে জমে থাকে না। ফলে ত্বকের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি পায়।  

সানস্ক্রিন ক্রিম ব্যবহার নিয়ে কমন কিছু প্রশ্ন উত্তর:

সানস্ক্রিন ক্রিমের ব্যবহার নিয়ে রয়েছে নানাজনের নানা জিজ্ঞাসা। কখন এপ্লাই করবো, কীভাবে এপ্লাই করবো এসব নিয়ে রয়েছে নানা ধরনের ভ্রান্ত ধারণা। চলুন জেনে নিই সানস্ক্রিন নিয়ে কমন কিছু জিজ্ঞাসা। 

বাইরে বের হওয়ার কতক্ষণ আগে সানস্ক্রিন এপ্লাই করবো?

এটা অনেকেরই খুব কমন একটা জিজ্ঞাসা যে বাইরে বের হবার ঠিক কতক্ষণ আগে সানস্ক্রিন ব্যবহার করবো। ত্বকের যত্নে কোনো স্কিনকেয়ার পণ্যই একটার পর একটা সাথে সাথে ব্যবহার করা উচিত নয়। আপনি যখন ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করছেন তখন সেটা এপ্লাই করার পর কমপক্ষে ১০ মিনিট অপেক্ষা করুন যেন ত্বকে সেটা পুরোপুরি বসে যায়। 

ঠিক একই কথা প্রযোজ্য সানস্ক্রিনের ক্ষেত্রে। সাধারণত বাইরে যাওয়ার ২০/৩০ মিনিট আগে সানস্ক্রিন লাগানো ভালো। এক্ষেত্রে সেটি ত্বকের সাথে পুরোপুরি মিশে যাওয়ার সময় পায় এবং প্রয়োজনীয় লেয়ার তৈরি করতে সহায়তা করে। 

রান্না করতে গেলে বা চুলার কাছে গেলে কি সানস্ক্রিন ব্যবহার করতে হবে?

দিনের বেলায় যদি রান্নাঘরে লম্বা সময় কাজ করতে হয় তবে এসপিএফযুক্ত সানস্ক্রিন ব্যবহার করুন। কারণ চুলার তাপে ত্বকে পোড়া ও কালোভাব তৈরি হয়। এসপিএফযুক্ত সানস্ক্রিন আপনার ত্বককে চুলার তাপ থেকে রক্ষা করবে। 

আগে ময়েশ্চারাইজার এপ্লাই করবো না সানস্ক্রিন?

সকালে ঘুম থেকে উঠে বেসিক স্কিনকেয়ার রুটিনের প্রথম ধাপ ক্লিনজিং। এরপরে আপনি চাইলে টোনিং করতে পারেন, তবে ময়েশ্চারাইজার অবশ্যই ব্যবহার করতে হবে। কাজেই সবসময় আগে ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করে তারপর সানস্ক্রিন এপ্লাই করবেন। 

মেকআপ করার আগে কখন সানস্ক্রিন অ্যাপ্লাই করবো?

মেকআপ করার আগে স্কিনকেয়ারের যে বেসিক রুটিন আছে সেগুলোর শেষ ধাপে সানস্ক্রিন ব্যবহার করুন। অর্থাৎ সানস্ক্রিন লাগিয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে প্রাইমার দিয়ে মেকআপ শুরু করুন।  

ত্বকের যত্নে সানস্ক্রিন ক্রিমের বিকল্প নেই। আপনি যেই ধরনের স্কিনের অধিকারীই হন না কেন, স্কিনের সাথে মিলিয়ে বাজারে নানা ধরনের সানস্ক্রিন পাবেন। ত্বকের সাথে মিলিয়ে সানস্ক্রিন বাছাই করুন এবং সঠিক নিয়মে ব্যবহার করুন। নিয়মিত ত্বকের যত্ন করলেই আপনার ত্বক থাকবে হেলদি ও গ্লোয়িং। 

Scroll to Top